কালিন্দী হলে কালীয় নাগ নামে এক বিষধর সাপ বাস করত। তার বিয়ে ঐ হ্রদের জল বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। ঐ জল পান করে সেখানকার জীবজন্তু সহ অনেকেই মারা যায়। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর গোপবালক বন্ধুদের সঙ্গে ঐ হ্রদের পাড়ে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে খেলা করছিল। কৃষ্ণের কয়েকজন তৃষ্ণার্ত বন্ধু ঐ হলের জল পান করল এবং তৎক্ষণা মারা গেল। সকলে এ দৃশ্য দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল এবং এর কারণ খুঁজতে লাগল। এমন সময় শ্রীকৃষ্ণ সেখানে এলেন।
শ্রীকৃষ্ণঃ কী হয়েছে এখানে? আমাকে বলো।
প্রথম গোপবালক বন্ধু : কেন তুমি জানো না! কালিন্দী হ্রদে একটি ভয়ংকর সাপ এসেছে। হলের সব জল বিষাক্ত করে ফেলেছে। হ্রদের অনেক মাছ মরে যাচ্ছে।
শ্ৰীকৃষ্ণঃ বলো কী।
দ্বিতীয় গোপবালক বন্ধু: শুধু কি তাই! ঐ জল পান করে আমাদের কয়েকজন বন্ধু মারা গেছে।
তৃতীয় গোপবালক বন্ধুঃ এলাকার বহু জীবজন্তুও মারা গেছে। (সবাই কান্নাকাটি করতে লাগল)
চতুর্থ গোপবালক বন্ধু : আমরা এখন পানীয় জল পাবো কোথায়?
শ্ৰীকৃষ্ণঃ চিন্তা করো না, সাপটিকে আমি এখনই তাড়িয়ে দিচ্ছি।
গোপবালক বন্ধুরা (সমস্বরেঃ) তুমি যেয়ো না বন্ধু! ও ভয়ংকর সাপ।
শ্ৰীকৃষ্ণঃ তোমরা আমার জন্য ভেবো না। ভয় পেয়ো না। আমার কিছু হবে
গোপবালকদের সাথে এলাকাবাসীরাও আশার আলো দেখতে পেল।
এলাকাবাসীকে রক্ষা করতে শ্রীকৃষ্ণ সাহসিকতার সাথে লড়াই করে সাপটিকে দুর্বল করে ফেলেন। সাপটি ছিল মূলত কালীরনাথ। শ্রীকৃষ্ণ কালীয়কে হ্রদ থেকে তাড়িয়ে দিলেন। বিষাক্ত সাপ থেকে রক্ষা পেল এলাকাবাসী। তারা প্রাণে বেঁচে গেল। সকলে শ্রীকৃষ্ণের প্রশংসা করতে লাগলেন।
নাটিকাটিতে অভিনয় করে নিশ্চয়ই তোমরা অনেক আনন্দ পেয়েছ। এখানে আমরা দেখলাম শ্রীকৃষ্ণ নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে গোপবালক বন্ধুসহ এলাকাবাসীর জীবন বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন। এবার আমরা আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে এরকম মানবিক ও নৈতিক গুণাবলির একটি ঘটনা লিখব।
আমরা সমাজে বাস করি। সমাজে ভালো-মন্দ দুই-ই থাকে। কিন্তু আমরা সবাই বুঝতে পারি না, কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ। অথচ আমাদের ভালো-মন্দ বোঝা খুবই জরুরি। কারণ ভালো কাজ না করলে। আমরা ভালো থাকি না। সমাজ ভালো থাকে না। এই ভালো-মন্দ বোঝার জন্য জ্ঞান থাকতে হবে। ভালো- মন্দ বা ভালো কাজ মন্দ কাজ বোঝার জ্ঞানকে বলা হয় নীতি। নীতির সঙ্গে যা যুক্ত হয় তা নৈতিকতা। পরমতসহিষ্ণুতা, মানবিকতা, সহমর্মিতা, দায়িত্বশীলতা এ সবই নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত। হিন্দুধর্ম গ্রন্থসমূহে নৈতিকতা সম্পর্কে অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা আছে। এর পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক অনেক উপাখ্যান আছে। এর মধ্য দিয়ে আমরা নৈতিক শিক্ষা লাভ করতে পারি। এখন আমরা মানবিকতা, সহমর্মিতা ও দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে জানব । আমরা এখানে ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত দৃষ্টান্তমূলক উপাখ্যান থেকে শিক্ষা লাভ করব।
স্বামী বিবেকানন্দের মানবিকতা
বিবেকানন্দের জন্ম ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। তাঁর পিতার নাম বিশ্বনা ও মাতার নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন আমেরিকায় যান তখন তিনি ছিলেন ৩০ বছরের এক যুবক। সেই সময় আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে তিনি যোগদান করেন। এই সম্মেলনে তিনি হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। তাঁর বক্তৃতা প্রশংসিত হয় এবং তিনি শ্রেষ্ঠ। বক্তায় পরিণত হন। এই বক্তৃতা তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান ব্যক্তিতে পরিণত করে। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি। আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন। কলকাতায় তাকে বিশাল সংবর্ধনা দেওয়া হয় এবং দেশে-বিদেশে তাঁর জয়জয়কার পড়ে যায়। বিশ্বজোড়া তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এসব নাম ও খ্যাতির উপরে তার বড় পরিচয় তিনি ছিলেন মানবতাবাদী ও মানবদরদি। তাঁর মানবসেবার কোনো তুলনা হয় না। এখানে তার একটা দুষ্টয়ে দেওয়া হলো।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা থেকে ফিরে এসেই তিনি বহু কাজ হাতে নেন এবং পরিকল্পনা করেন অনেক কাজের। এর মধ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় সমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার জন্য বিদেশ থেকে অনেক আমন্তন আসছিল। কিন্তু কিছুদিন পর কলকাতায় দেখা দিল প্লেগ রোগের মহামারী। আমরা করোনা মহামারীর কথা জানি। করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল প্লেগ মহামারী। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন বহু লোকের মৃত্যু হতে লাগল। শোনা যায়,
কলকাতার প্রায় তিন ভাগ লোক মৃত্যুভয়ে শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বিবেকানন্দ তাঁর সমস্ত কাজ বন্ধ করে দিলেন। তাঁর একমাত্র কাজ হলো প্লেগে আক্রান্ত রোগীদের সেবা করা এবং তাদের সুস্থ করে তোলা। তিনি তাঁর অনুগামী সাধু-সন্ন্যাসীদের নিয়ে সভা করলেন। তাদের বললেন- "আমরা মরণকে ভয় করে প্রেগ রোগীদের কাছ থেকে দূরে থাকব না। তাদের ঔষধ দিব এবং চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করব।' তিনি বললেন, "প্রয়োজনে টাকার জন্য আমরা মঠের জমি বিক্রি করব। আমরা আমাদের জীবন দিতেও প্রস্তুত আছি।' এই সময় রাস্তায় প্রচুর ময়লা জনে গিয়েছিল। মৃত্যুর ভয়ে ময়লা পরিষ্কার করার কাজ যাদের, সেই মেথররাও রাস্তায় নামছিল না। ফলে, ময়লা থেকে রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছিল। এমনি এক অবস্থায় রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ময়লা পরিষ্কার করা খুবই দরকার ছিল। বিবেকানন্দ তাঁর সাধু-সন্ন্যাসী ভাই ও অনুগামীদের নিয়ে রাস্তায় নামলেন। নিজেরা ঝাঁটা হাতে রাস্তা পরিষ্কার করতে লাগলেন। বিবেকানন্দের শিষ্য সিস্টার নিবেদিতাও ঝাঁটা হাতে রাস্তা পরিষ্কারে নেমে ছিলেন। তাদের দেখে মেথররা রাস্তায় নামলেন। তাদের নিয়মিত কাজ রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার করা শুরু করলেন। বিবেকানন্দ প্রচারপত্রে জানালেন এবং সবাইকে বললেন, 'মৃত্যু সকলেরই হবে। কাপুরুষরাই বারবার মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে। যা আমাদের অভয় দিচ্ছেন। ভয় নাই, ভয় নাই।” বিবেকানন্দ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে প্লেগ রোগীদের কাছে পেলেন। তাদের অক্লান্ত চেষ্টায় অনেক প্রেগ রোগী সুস্থ হলো। অনেকে মৃত্যুপথ থেকে ফিরে এল। তারপর একসময় কলকাতা প্লেগ রোগ থেকে মুক্ত হলো।
বিবেকানন্দের এই মানব সেবার কোনো তুলনা নেই। তিনি অতি সাধারণ মানুষের সেবা করেছেন। সারা জীবন তিনি সাধারণ মানুষের কথা ভেবেছেন। তাঁর কাছে মানবসেবাই ছিল ঈশ্বরসেবা, ভগবানের সেবা। ভগবানের এক নাম নারায়ণ। তিনি উপাসা নারায়ণ থেকে মনুষ্য নারায়ণকেই বড় উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এটা মোটেই সহজ কথা নয়। ভগবানের জায়গায় সাধারণ মানুষকে স্থান দিয়ে তাদের সেবা করা সহজ নয়। বিবেকানন্দ বলেছেন, 'আমার সব থেকে বড় উপাসা পাপী নারায়ণ, তাপী নারায়ণ, সর্বজাতির দরিদ্র নারায়ণ।"
দায়িত্বশীলতা
আমরা একজন অসাধারণ মানুষের কথা জানব। জানব তাঁর দায়িত্বশীলতার কথা। দায়িত্ব, দায়িত্বীলতা সম্পর্কে আমরা জানি। কারও ওপর কিছু করার ভার দেওয়া হয়। এই ভার নেয়াটাই দায়িত্ব। আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দায়িত্ব আছে। সে দায়িত্ব পালন করা উচিত। এই দায়িত্ব পালন করার বিষয়টি হলো দায়িত্বশীলতা। আমরা এখন একজন অসাধারণ দায়িত্বশীল মানুষের কথা জানব। তিনি ভরত।
আমরা রামায়ণের কথা জানি। রামায়ণের একজন রাজার নাম দশরথ। তিনি অযোধ্যার রাজা ছিলেন। দশরথের তিন স্ত্রী। কৌশল্যা, কৈকেয়ী ও সুমিত্রা। তিন স্ত্রীর চার ছেলে। কৌশল্যার ছেলে রামচন্দ্র। কৈকেয়ীর ছেলে ভরত। আর সুমিত্রার যমজ ছেলে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্ন।
রাম ভাইদের মধ্যে বড়। দশরথ বড় ছেলে রামচন্দ্রকে সিংহাসনে বসানোর আয়োজন করলেন। কিন্তু এতে কৈকেয়ী বাধা দিলেন। তিনি বললেন, তার ছেলে ভরতকে সিংহাসনে বসাতে হবে। এক সময় নশর কৈকেয়ীকে দুটি বর দিতে চেয়েছিলেন। কৈকেয়ী সেই দুটি বর চাইলেন। এক বরে ভরত রাজা হবে। আরেক করে রামচন্দ্র চৌদ্দ বছরের জন্য বনবাসে যাবেন। রামচন্দ্র পিতৃসত্য পালনে বনে চলে গেলেন। রামচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী সীতা গেলেন। ভাই লক্ষ্মণও গেলেন। ছেলের শোকে-দুঃখে রাজা দশরথের মৃত্যু হলো। এসব ঘটনার কিছুই জানতেন না ভরত। তিনি তখন তাঁর মামাবাড়িতে ছিলেন। শত্রুরও ছিলেন ভরতের সঙ্গে।
ভরতকে সব সংবাদ দেয়া হলো। তিনি ফিরে এলেন অযোধ্যায়। সব কথা শুনলেন। মায়ের ওপর তাঁর খুব রাগ হলো। খুব কষ্ট পেলেন। তিনি রাজা হতে চাইলেন না। বড়ো ভাই রামচন্দ্রকে ফিরিয়ে আনতে বনে গেলেন। কিন্তু রামচন্দ্র শত অনুরোধেও ফিরলেন না। তখন ভরত রামচন্দ্রের কাছে তার দুটি পাদুকা চাইলেন। তিনি বললেন, এই পাদুকা সিংহাসনে থাকবে। রামচন্দ্রের পক্ষে সেবক হিসেবে তিনি রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন।
ভরত চৌদ্দ বছর রাজা ছিলেন। কিন্তু তিনি নামেই রাজা ছিলেন। রামচন্দ্রই ছিলেন প্রকৃত রাজা। রাম পক্ষে তিনি রাজার দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। চৌদ্দ বছর ভরত কোনো রাজভোগ গ্রহণ করেননি। সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করেছেন। রামচন্দ্র বনবাসে ছিলেন। বনে বনে ঘুরে কষ্ট পেয়েছেন। ভরত সেকথা স্মরণ করেছেন। রাজবাড়িতে রাজা হয়েও তিনি বনবাসীর মতো থেকেছেন। কিন্তু এই চৌদ্দ বছর তিনি রাজ্যের অনেক উন্নতি করেছেন। রাজ্যের প্রজারা সুখী ছিল। চৌদ্দ বছর পর রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে এলেন। ভরত রামচন্দ্রকে তাঁর রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন। বড় ভাইয়ের প্রতি ভরতের এই শ্রদ্ধা-ভালোবাসার তুলনা হয় না। তুলনা নেই তাঁর দায়িত্বশীলতারও।
দায়িত্বপালন ও দায়িত্বশীলতার জন্য ভরত একজন আদর্শ মানুষ। তিনি অসাধারণ মানুষ। দায়িত্বশীলতার জন্য ভরত চিরস্মরণীয়। চির অনুসরণীয়। ভরতের আদর্শকে আমরা স্মরণ করব। ভরতকে আমরা অনুসরণ
আদর্শ জীবনচরিত
আমাদের সমাজে কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সব সময় সকলের মঙ্গলের কথা বলেন। এঁরা সকলকে ভালোবাসেন। নিজের কথা বেশি ভাবেন না। এই মানুষদের আমরা মহাপুরুষ বলি। সাধক বলি। আদর্শ মানুষ বলি। এঁদের জীবনচরিত আমাদের অনুসরণীয়। আদর্শ মানুষের জীবনচরিত আলোচনা করলে, তাঁদের অনুসরণ করলে আমরাও ভালো মানুষ হতে পারি। এই আদর্শ মানুষদের মধ্যে অনেকে অলৌকিক গুণসম্পন্ন হন। অনেকে ঐশ্বরিক শক্তিও লাভ করেন। আমরা এখানে কয়েকজনের জীবনচরিত আলোচনা করব। এঁদের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ। সর্বোত্তম।
শ্রীকৃষ্ণ
শ্রীকৃষ্ণের জীবনচরিত অতুলনীয়। শৈশব থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি বহু কাজ করেছেন। অসীম তাঁর কার্যাবলী। এখানে কেবল তাঁর শৈশবকালের কিছু কথা আমরা জানব।
শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল মথুরায়। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে। তাঁর জন্মের কারণে এই তিথিটি জন্মাষ্টমী নামে পরিচিত। শ্রীকৃষ্ণের পিতার নাম বসুদেব। মাতা দেবকী। দেবকী ছিলেন মথুরার রাজা কংসের জাতিভগিনী। কংসের খুড়তুতো বোন। কংস খুবই অত্যাচারী ছিলেন। এত অত্যাচারী ছিলেন যে নিজের বাবা উগ্রসেনকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দেন। তাঁকে কারাগারে আটকে রাখেন আর নিজে রাজা হন।
কংস দৈববাণী থেকে জানতে পেরেছিলেন, দেবকীর অষ্টম সন্তান তাঁকে হত্যা করবে। একথা জেনে তিনি বসুদেব-দেবকীর ওপরও অত্যাচার শুরু করেন। তাঁদের দুজনকে তিনি কারাগারে আটকে রাখেন। দেবকীর ছয় সন্তানকে তিনি মেরে ফেলেন। সপ্তম সন্তান অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়। এই সন্তানের নাম বলরাম। বলরাম গোকুলে নন্দরাজার ঘরে বড়ো হতে থাকেন। বসুদেব-দেবকীর অষ্টম সন্তান শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সময়ে রাত্রে খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। বসুদের অনেক কষ্টে কৌশলে কৃষ্ণকে নিয়ে পালিয়ে যান। মনুয়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা নদী। এই যমুনা নদীর ওপারে গোকুল। বসুদের যমুনা পার হয়ে কৃষ্ণকে নিয়ে চলে যান গোকুলে।
সেখানে ছিল নন্দরাজার বাড়ি। নন্দরাজা ছিলেন বসুদেবের বন্ধু। বসুদেব নন্দরাজার ঘরে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন নন্দের স্ত্রী যশোদার একটি মেয়ে হয়েছে। বসুদেব কৃষ্ণকে যশোদার পাশে রেখে দেন। আর মেয়েটিকে নিয়ে আসেন। মেয়েটিকে রাখেন দেবকীর পাশে। এসব ঘটনা কেউ জানতে পারেনি। পরদিন সকালে কংস দেবকীকে দেখতে যান। তিনি দেখেন দেবকীর একটি মেয়ে হয়েছে। কংস মেয়েটিকে নিয়ে পাথরের ওপর ছুঁড়ে মারেন। কিন্তু মেয়েটি মরল না। বরং মেয়েটি ওপরে উঠে গেল। আর বলে গেল, 'কংস, তোকে যে মানবে সে অন্য কোথাও জন্ম নিয়েছে।"
সব কথা শুনে কংসের তো মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। তিনি মধুরা এবং গোকুলের সব শিশুকে মারার পরিকল্পনা করলেন। তিনি তার অনুচরদের ছদ্মবেশে পাঠালেন গোকুলে। এই অনুচররা অসুর ও রাক্ষস শ্রেণির। এদের অলৌকিক শক্তি আছে। নানা রূপ ধারণ করতে পারে এরা। অনেক শিশু তাদের হাতে মারা গেল।
কৃষ্ণ এখন তাঁর পালক পিতা-মাতা নন্দ-যশোদার ছেলে। তিনি একটু একটু করে বড়ো হচ্ছেন। একদিন কৃষ্ণ একটি শকটের নিচে শুয়ে ছিলেন। যা যশোদা তখন একটু দূরে ছিলেন। মাকে না পেয়ে কৃষ্ণ হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে লাগলেন। শক্তিমান শিশু কৃষ্ণের পায়ের আঘাতে শকটটি ভেঙে গেল। সকলের বিশ্বাস শকটের মধ্যে এক অসুর লুকিয়ে ছিল। শকটের সঙ্গে সেই অসুর মরে গেল।
আর একদিন পুতনা নামে এক রাক্ষসী এল। সে খুব সুন্দরী হয়ে এসেছিল। যশোদার কাছ থেকে কৃষ্ণকে সে চেয়ে নিল। কৃষ্ণকে আদর করতে লাগল। তারপর একটু দূরে গিয়ে বুকের দুধ খেতে দিল। আসল ব্যাপার হলো, পুতনা তার স্তনে বিষ মাখিয়ে রেখেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, বিষমাখানো এই স্তন পান করে কৃষ্ণ মরে যাবে। কিন্তু কৃষ্ণ এমনভাবে দুধ পান করলেন যে পুতনা চিৎকার করতে লাগল। চোষ বেরিয়ে এলো তার। অনেক দূরে গিয়ে সে পড়ে মরে গেল।
এরপর একদিন তৃণাবর্ত নামে এক অসুর এলো। সে প্রচন্ড ধূলিঝড় দিয়ে কৃষ্ণকে উড়িয়ে নিল। কিন্তু কৃষ্ণ
ওপরে দিয়ে তৃণাবর্তের গলা জোরে জড়িয়ে ধরল। কৃষ্ণের প্রচণ্ড চাপে মরে গেল তৃণাবর্ত।
এভাবে কৃষ্ণ তার শিশুবেলাতেই অনেক দুষ্ট অসুর-রাক্ষসদের মেরেছেন। তাদের মেরে নিজেকে রক্ষা করেছেন। গোকুলের শিশুদেরও রক্ষা করেছেন। এই বয়সে তিনি জীবসেবাও করেছেন। জীবের প্রতি তাঁর অনেক ভালোবাসা ছিল। তিনি ঘর থেকে ঘি-মাখন-দই প্রভৃতি এনে বানরদের খাওয়াতেন। তিনি এই বয়সে মানুষের সেবাও করেছেন। এক বৃদ্ধা ফল বিক্রি করতেন। চলাফেরায় তাঁর খুব কষ্ট হতো। কৃষ্ণ ঘর থেকে ঢাকা-পয়সা এনে তাঁকে দিয়ে দিতেন। এভাবে তিনি একজন গরিব বৃদ্ধাকে সাহায্য করেছেন।
এক সময় তিনি বড়ো ভাই বলরামকে নিয়ে মথুরায় যান। সেখানে তিনি অত্যাচারী কংসকে হত্যা করেন। উগ্রসেন এবং তাঁর বাবা-মাকে কারাগার থেকে উদ্ধার করেন। এ সবকিছুই হয় তাঁর কিশোর বয়সের মধ্যে।
শিশুবয়সে কৃষ্ণ খুব দুরন্ত ছিলেন। শক্তিশালী ছিলেন। সমবয়সী বালকের তুলনায় তিনি দীর্ঘ ছিলেন। অনেক বুদ্ধি ছিল তাঁর।
বড়ো হয়ে কৃষ্ণ সমাজসংস্কার করেন। ধর্মসংস্কার করেন। রাজনীতির আদর্শ স্থাপন করেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তিনি অর্জুনের রথের সারথি ছিলেন। তাঁর মুখেই শোনা গেছে গীতার অমৃত বাণী।
শ্রীকৃষ্ণ আমাদের আদর্শ। তিনি ভগবানের আসনে আসীন। তবে তিনি মানুষ হিসেবেই সকল আদর্শ স্থাপন করেন। আমরা তাঁর আদর্শ জীবনচরিত আলোচনা করব। আমরা সমৃদ্ধ হয়। শক্তি পাব। আদর্শ মানুষ হওয়ার প্রেরণা পাব।
লোকনাথ ব্রহ্মচারী
লোকনাথ ব্রহ্মচারী একজন মহাপুরুষ। ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জন্ম। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার চাকলা নামক গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রামকানাই চক্রবর্তী। মাতা কমলা দেবী। রামকানাই চক্রবর্তীর ইচ্ছা ছিল, তাঁর পুত্রদের মধ্যে একজন ব্রহ্মচারী হবেন। লোকনাথ পিতার ইচ্ছা পুরণ করেন। আচার্য ভগবান গাঙ্গুলীর কাছে তিনি দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ভগবান গাঙ্গুলীর দীক্ষিত শিষ্য হলেন। তাঁর প্রিয় বন্ধু বেণীমাধব ও ভগবান গাঙ্গুলীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। একদিন তাঁরা গৃহত্যাগ করেন। গুরুর তত্ত্বাবধানে তাঁরা কঠোর সাধনায় রত হন। কালীঘাট, কাশীধাম ও হিমালয় পর্বতে তাঁরা কঠোর সাধনা করেন। এভাবে তাঁদের পঁচিশ বছর কেটে যায়। এরপর তাঁরা দেশ পরিভ্রমণে বের হন। তাঁরা আফগানিস্তান, মক্কা, মদিনা ও চীন দেশ ভ্রমণ করেন। এরপর আবার হিমালয়ে সাধনার জন্য চলে আসেন। একসময় গুরুর নির্দেশে দুই বন্ধু আলাদা হয়ে গেলেন। বেণীমাধব ভারতের কামাখ্যা মন্দিরে গেলেন। বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে এলেন। লোকনাথ ব্রহ্মচারী। এখান থেকেই শুরু হলো তাঁর মানবসেবা। একদিন এক বটগাছের নিচে লোকনাথ ব্রহ্মচারী ধ্যান করছিলেন। এমন সময় ডেঙ্গু কর্মকার নামে এক দরিদ্র লোক সেখানে আসেন। তাঁর পা জড়িয়ে ধরলেন। তিনি ফৌজদারি মামলার আসামী। মামলার বিচারে তার কঠিন শাস্তি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। এই মহাবিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি লোকনাথ ব্রহ্মচারীকে অনেক অনুনয় করেন। লোকনাথের কৃপায় মামলা থেকে তিনি মুক্তি পান। পরবর্তীকালে ডেঙ্গু কর্মকার তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি লোকনাথের সঙ্গে ছিলেন।
লোকনাথ ব্রহ্মচারী ছিলেন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর স্পর্শে অনেক অসুস্থ মানুষ সুস্থ হয়ে যেত। বিপদ থেকে উদ্ধার পেত। একবার বারদীর পাশের গ্রামে এক ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। সব মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। লোকনাথ তাদের পালাতে নিষেধ করলেন। তাঁর কৃপায় ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্তরা সুস্থ হয়ে ওঠে। এতে তাঁর প্রতি মানুষের বিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। এভাবে লোকনাথ, 'বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী' নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। দেশ-বিদেশে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
লোকনাথ ব্রহ্মচারী শুধু মানুষ নয়, জীবজন্তু এবং পশুপাখিকেও সমানভাবে ভালোবাসতেন। নারা জেলার সোনারগাঁও উপজেলার বারদী গ্রামে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম। সেখানে অনেক পশুপাখি থাকত। তিনি নিজের হাতে তাদের খাবার দিতেন। পরিচর্যা করতেন। পাখিরা নির্ভয়ে তাঁর শরীরে এসে বসত। তিনি সকল জীবের মধ্যেই ব্রহ্মের উপস্থিতি অনুভব করতেন। জীবের কল্যাণ করে যে আনন্দ পাওয়া যায় সেটাই ছিল তাঁর কাছে ব্ৰহ্ম
বাবা লোকনাথ ছিলেন একজন আদর্শ মহাপুরুষ। তাঁর মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সমাজের সবাইকে তিনি সমান চোখে দেখতেন। এজন্য সবার কাছে তিনি পরম পূজনীয় এবং প্রশ্নের ছিলেন। জীবসেবাই যে ঈশ্বরের সেবা তিনি তা অনুভব করতেন। এজন্যই তিনি সব সময় নিজেকে জীবের সেবায় নিয়োজিত রাখতেন। জীবসেবার বিষয়টি তিনি শিষ্যদেরকেও বোঝাতেন। মহাপুরুষ লোকনাথ ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে ১৬০ বছর বয়সে বারদীর আশ্রমে পরলোক গমন করেন। বর্তমানে বারদী একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র।
রাণী রাসমণি
রাণী রাসমণি ছিলেন একজন মহীয়সী নারী। ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে রাণী রাসমণির জন্ম। কলকাতার হালিশহরের নিকট কোনা নামক গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হরেকৃষ্ণ নাম মাতার নাম রামপ্রিয়া দাসী। হরেকৃষ্ণ দাসের পেশা ছিল গৃহ নির্মাণ ও কৃষিকাজ। জন্মের পর মা রামপ্রিয়া মেয়ের নাম রাখেন রাণী। পরে তাঁর নাম হয় রাসমণি। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিয়ে হয়। জমিদার রাজচন্দ্র দাস ছিলেন তাঁর স্বামী। গরিব ঘরে তাঁর জন্ম। কিন্তু তিনি রাণীর পদে অধিষ্ঠিত হন। তাঁদের চারটি কন্যাসন্তান ছিল— পদ্মমনি, কুমারী, করুণা এবং জগদম্বা।
রাজচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত কর্মকুশল এবং উদার প্রকৃতির মানুষ। তাঁর ব্যবহার ছিল অমায়িক। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্ত্রী রাসমণির অনুপ্রেরণা। এই জমিদার পরিবার অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেছে। তাঁরা অনেক অসহায় পরিবারকে সাহায্য করেছেন। রাজচন্দ্র ও রাসমণির দাম্পত্য জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে রাজচন্দ্র মৃত্যুবরণ করেন। ফলে জমিদারির সমস্ত দায়িত্ব রাসমণির ওপর এসে পড়ে।
রাসমণি অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন। সেসবের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হলো, পুরীর জগন্নাথ ক্ষেত্রের সংস্কার সাধন। একবার তিনি পুণ্যভূমি জগন্নাথ তীর্থে যান। সেখানকার রাস্তাঘাট ছিল খুবই জরাজীর্ণ। তীর্থযাত্রীদের চলাফেরা করতে খুব কষ্ট হতো। রাসমণি সমস্ত রাস্তা সংস্কার করে দেন। তিনি তিন দেবতার জন্য তিনটি মুকুটও তৈরি করে দেন। তিন দেবতা হলেন- জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। মুকুট তিনটি ছিল হীরকখচিত। মুকুট তৈরিতে লেগেছিল ষাট হাজার টাকা।
রাসমণি খুব তেজস্বীও ছিলেন। একবার ইংরেজ সরকার গঙ্গায় মাছ ধরার জন্য জেলেদের ওপর কর আরোপ করে। জেলেদের করা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। জেলেরা খুব অসহায় হয়ে পড়ে। তারা মমতাময়ী রাণী রাসমি কাছে যায়। রাসমণি টাকা দিয়ে ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে গঙ্গার লিজ নেন। গঙ্গার ঐ অংশটি তখন রাসমণির অধিকারে আসে। রাসমনি গঙ্গায় ইংরেজদের জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেন। ইংরেজরা তখন বাধ্য হয় রাসমণির সঙ্গে আপস মীমাংসা করতে। জেলেরা কর ছাড়াই মাছ ধরার অধিকার পায়।
রাণী রাসমণির উল্লেখযোগ্য অবদান হলো দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির নির্মাণ। লোকের বিশ্বাস, তিনি মা কালীর আদেশ পেয়েছিলেন। তিনি গঙ্গার তীরে জমি ক্রয় করে কালীমন্দির নির্মাণ করেন। রাণী সেখানে প্রতিদিন পূজা দিতেন। এক সময় গদাধর নামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ মন্দিরের পুরোহিতের দায়িত্ব পান। তিনিই পরবর্তীকালে হন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। রামকৃষ্ণের বিখ্যাত শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে রাণী রাসমণির মৃত্যু হয়। সাধারণ পরিবারে তাঁর জন্ম কিন্তু কর্মের দ্বারা তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। কর্মই শ্রেষ্ঠ - রাণী রাসমণির জীবনী থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ
শ্রীরামকৃষ্ণ ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা চন্দ্রমণি দেবী। তাঁর বালানাম ছিল গদাধর। বাল্যকালে গদাধর দেখতে। খুবই সুন্দর এবং সদাপ্রসন্ন ছিলেন। লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগ ছিল না তবে প্রকৃতিকে খুবই ভালোবাসতেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করত। ভজন-কীর্তনের প্রতি তাঁর খুব আকর্ষণ ছিল। লোকমুখে শুনে শুনে তিনি বৈদিক স্তব-স্তোত্র এবং রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি আয়ত্ত করেন।
পিতার মৃত্যুর পর গদাধরের জীবনে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। জীবনের প্রতি অনেকটা উদাসীন হয়ে কখনও নির্জনে, কখনও বা শ্মশানে গিয়ে বসে থাকতেন। এ অবস্থা দেখে তাঁর অগ্রজ রামকুমার তাঁকে কলকাতা নিয়ে যান। রামকুমার ছিলেন রাণী রাসমনি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের পুরোহিত। সেখানে গদাধর প্রায়ই মায়ের মন্দিরে ভারতময় হয়ে থাকেন। মাঝে মধ্যে আবার আত্মমগ্ন অবস্থায় গঙ্গাতীরে ঘুরে বেড়াতেন।
রামকুমারের মৃত্যুর পর গদাধর দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে মায়ের পূজার ভার গ্রহণ করেন। এখানেই তাঁর সাধন জীবনের শুরু। তিনি মনেপ্রাণে মায়ের পূজায় মনোনিবেশ করেন। পূজা করতে তিনি প্রায়ই ভাবে অচেতন হয়ে পড়তেন। 'মা', 'মা' বলে আকুল হয়ে যেতেন। তাঁর আকুল আহ্বানে একদিন মা কালী জ্যোতির্ময়ী রূপে তাঁর কাছে আবির্ভূত হন ।
মায়ের দেখা পেয়ে ভাবের আবেশে তিনি উন্মাদের ন্যায় আচরণ শুরু করেন। এ খবর পেয়ে মাতা চন্দ্রমণি তাঁকে বাড়ি নিয়ে যান এবং রাম মুখুজ্যের মেয়ে সারদাদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন।
বিয়ের কিছুদিন পর সারদাদেবীকে গ্রামে রেখে গদাধর পুনরায় দক্ষিণেশ্বরে ফিরে আসেন। কারণ সংসারের প্রতি তাঁর কোনো মোহ ছিলনা। এ সময় তিনি বিভিন্ন যোগীপুরুষের সান্নিধ্য লাভ করেন। এর মধ্যে সন্ন্যাসী তোতাপুরী তাঁকে বেদান্ত সাধনায় দীক্ষিত করেন এবং তাঁর নাম রাখেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। শ্রীরামকৃষ্ণ হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সাধনপথ শাক্ত, বৈষ্ণব, তান্ত্রিক প্রভৃতি মতে সাধনা করেন। এমনকি ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মমতেও সাধনা করেন। সব ক্ষেত্রেই তিনি সিদ্ধিলাভ করেন। তিনি
বলেন, “নিষ্ঠার সঙ্গে সাধনা করলে সব পথেই ঈশ্বরকে লাভ করা যায়।" তিনি মনে করতেন 'যত মত তত পথ'। অর্থাৎ পথ বহু হলেও লক্ষ্য এক .. ঈশ্বর লাভ
শ্রীরামকৃষ্ণের এই সাধনা ও তাঁর পরমতসহিষ্ণুতার কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ফলে অনেক জ্ঞানী-গুণী দক্ষিণেশ্বরে তাঁর কাছে আসতে লাগলেন। তিনি তাঁদের গল্পের মাধ্যমে অনেক জটিল তত্ত্ব বুঝিয়ে দিতেন।
একদিন এলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি সরাসরি শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রশ্ন করলেন, 'আপনি কি ঈশ্বর দেখেছেন?" উত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, 'হ্যাঁ, নিশ্চয় দেখেছি, এই তোকে যেমন দেখছি। তোকেও দেখাতে পারি, দেখবি?" নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপায় ঈশ্বর দর্শন করে ধন্য হলেন এবং তাঁর চরণে নিজেকে সমর্পণ করলেন। এই নরেন্দ্রনাথই হলেন শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামী বিবেকানন্দ সারদা দেবীকেও মাতৃজ্ঞানে পূজা করতেন এবং সব সময় না বলেই সম্বোধন করতেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী থেকে আমরা এই নীতিশিক্ষা পাই যে, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হবে। ঈশ্বরজ্ঞানে জীবের সেবা করতে হবে। পিতা, মাতা এবং জন্মভূমিকে শ্রদ্ধা করতে হবে। সকল ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু হতে হবে। তাহলে আর ধর্মীয় সংঘাত দেখা দেবে না। সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকলে সম্প্রীতি বজায় থাকবে। আমরা সকলে শ্রীরামকৃষ্ণের এই জীবনাদর্শ অনুসরণ করব।
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট এই মহাপুরুষ পরলোকগমন করেন।
উপরে আমরা তিনজন মহাপুরুষ ও একজন মহীয়সী নারীর জীবনী পড়লাম। আমরা জানলাম, দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্য তাঁরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁদের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমরাও আমাদের সাধ্যমত মানুষের দুঃখ কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করব। এরই অংশ হিসেবে আমরা বিনিময় স্টলের কথা ভাবতে পারি। আমাদের অনেকের বাড়িতে অনেক জিনিস থাকে যা ব্যবহারযোগ্য। কিছু অপ্রয়োজনীয় মনে করে ফেলেদি। এ জিনিসগুলোই আবার অনেকের প্রয়োজনে লাগতে পারে। এসব জিনিস আমরা বিনিময় স্টলে রাখতে পারি। যাদের প্রয়োজন তারা এটা ব্যবহার করবে। ব্যবহারের পর ভালো থাকলে আবার বিনিময় স্টেলে রেখে যাবে। এভাবে আমরা বিনিময় স্টলের মধ্য দিয়ে অনেকের উপকার করতে পারি। তবে বাড়ির কিছু নিতে গেলে পরিবারের বড়দের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তাদের অনুমতি নিতে হবে।
হিন্দুধর্মে সহাবস্থান
সকল ধর্মের মানুষের সাথে সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস হিন্দুধর্মের প্রধান ভাবনাগুলোর একটি। হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান গ্রন্থ গীতা'য় ফলের আশা না করে সকলের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। হিন্দুধর্মে সৃষ্টির সকল মানুষের মঙ্গলের জন্য ভালোবাসা নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যেতে বলা হয়েছে।
হিন্দুধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ এ মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের কল্যাণ, অপরের সাথে সম্প্রীতি নিয়ে সহাবস্থানের বিষয়ে চমৎকার কিছু বাণী আছে। স্থানী অরুণানন্দ সম্পাদিত পরম পবিত্র বেদসার সংগ্রহ থেকে কয়েকটি বাণী নিচে দেওয়া হলো:
মনুষ্যের মধ্যে কেহ বড় নয় বা কেহ ছোট নয়। ইহারা ভাই ভাই।
হে জ্যোতিঃ স্বরূপ! তুমি মানব সমাজের শক্তিপুঞ্জের সহিত অবস্থান কর এবং তুমিই যজমানের কর্মফল প্রদান কর। তুমি সকলেরই হিতকারী বন্ধু।
(সামবেদ পূর্বাচিক, ১/১/২)
হে দুঃখনাশক পরমাত্মন। আমাকে সুখের সহিত বর্জন কর। সব প্রাণী আমাকে মিত্রের দৃষ্টিতে দেখুক। আমি সব প্রাণীকে যেন মিত্রের দৃষ্টিতে দেখি। আমরা একে অন্যকে মিত্রের দৃষ্টিতে দেখিব।
(যজুর্বেদ, ৩৬/১৮)
হিন্দুধর্মের বিভিন্ন যুগের মহাত্মা মহাপুরুষেরা এই সম্প্রীতিরই জয়গান গেয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস অন্য ধর্মের আরাধনা পদ্ধতিকেও গভীরভাবে জানার চেষ্টা করেন। রামকৃষ্ণের মতে এই বিভিন্ন ধর্মের সাধনা ঈশ্বরকে উপলব্ধি করারই নামান্তর। তিনি বলেছিলেন সকল ধর্মের উদ্দেশ্য ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা, বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন পথে হাঁটলেও সকল ধর্মই স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করতে চায়। তাঁর বিখ্যাত বাণী হলো, 'সকল ধর্মই সত্য, যত মত তত পথ', অর্থাৎ বিভিন্ন ধর্মের মত ও পথ ভিন্ন হলেও তাদের উদ্দেশ্য ও গন্তব্য এক বা অভিন্ন।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় বলেছিলেন, "I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration but we accept all religions as true" যা বাংলায় লিখলে দাঁড়ায় এরকম: “আমি গর্বিত যে আমি এমন একটি ধর্মের যা বিশ্বকে সহনশীলতা এবং সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা শিখিয়েছে। আমরা কেবল সর্বজনীন সহনশীলতায় বিশ্বাস করি না, আমরা সকল ধর্মকেই সত্য বলে মেনে নিই।”
১৮১২ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষের গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করা হরিচাঁদ ঠাকুর হিন্দুধর্মে সম্প্রীতি-সহাবস্থানের আরেকটি উজ্জ্বল নাম। তিনি মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রবর্তক ছিলেন। তার প্রচলিত সাধন পদ্ধতিকে বলা হয় মতুয়াবাদ। মতুয়াবাদ সত্য, প্রেম ও পবিত্রতা এই তিনটি মূল স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ মতবাদে সকল মানুষ সমান; জাতিভেদ বা সম্প্রদায়ভের মতুয়াবাদে স্বীকৃত নয়। হরিচাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পরে তার পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়েছিলেন। এখন অবধি সেই ঐক্যের আলোয় ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি উপলক্ষে বিভিন্ন এলাকায় যে মেলার আয়োজন হয় তাতে অংশগ্রহণ করে এবং উৎসবে মেতে ওঠে।
হরিচাদ ঠাকুর যে বারোটি উপদেশ সকলের জন্য রেখে গিয়েছেন তা 'দ্বাদশ আজ্ঞা' নামে পরিচিত। এই দ্বাদশ আমার পঞ্চম আজ্ঞায় হরিচাঁদ ঠাকুর বলেছেন, "সকল ধর্মের প্রতি উদার থাকবে।" আর ষষ্ঠ আজ্ঞায় বলেছেন, “জাতিভেদ করবে না।”
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংঘজননী সারদা দেবীও সহাবস্থানের তাৎপর্য মনে করিয়ে দিয়েছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তার বলা শেষ বাণী ছিল, যদি শান্তি চাও, মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপন করে নিতে শেষ। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার।"
হিন্দুধর্মের প্রধান গ্রন্থসমূহ এবং মহাত্মা মহাপুরুষদের বাণী থেকে আমরা বুঝতে পারি হিন্দুধর্ম মানুষে মানুষে একসাথে সশ্রদ্ধ ভালোবাসা নিয়ে সহাবস্থানের কথা বলে। হিন্দুধর্ম দল-মত নির্বিশেষে সবার কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার কথা বলে। অন্যান্য ধর্মেও এই সহাবস্থানের কথা বারবার বলা হয়েছে। তোমার শিক্ষক এবং বন্ধুদের কাছ থেকে তুমি আরও অনেক কিছু জানতে পারবে।